ওয়াশিংটন ডি.সি.: ফক্স নিউজে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গাজায় পারমাণবিক হামলা চালানোর আহ্বান জানিয়েছেন মার্কিন কংগ্রেসম্যান র্যান্ডি ফাইন। রিপাবলিকান পার্টির এই সদস্যের এমন বিস্ফোরক মন্তব্যে ওয়াশিংটন থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া এবং বিতর্কের ঝড় উঠেছে। তার এই বক্তব্য ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতের প্রেক্ষাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং কঠোর অবস্থানকে নতুন মাত্রা দিয়েছে।
গত ২১ মে, বুধবার ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল ইহুদি জাদুঘরের বাইরে দুই ইসরায়েলি দূতাবাস কর্মীর ওপর গুলি চালানোর ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় কংগ্রেসম্যান র্যান্ডি ফাইন এই বিতর্কিত মন্তব্য করেন। সাক্ষাৎকারে তিনি ফিলিস্তিনিদের উদ্দেশ্যকে ‘খারাপ’ বলে আখ্যায়িত করে বলেন, গাজায় চলমান সংঘাতের একমাত্র সমাধান হলো সন্ত্রাসবাদকে সমর্থনকারীদের সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ। তার মতে, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য একটি কঠোর এবং আপসহীন পদক্ষেপ প্রয়োজন।
কংগ্রেসম্যান র্যান্ডি ফাইন তার বক্তব্যের সমর্থনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উদাহরণ টেনে তার অবস্থানকে ন্যায্য প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, আমরা নাৎসিদের সঙ্গে আত্মসমর্পণের জন্য আলোচনা করিনি। আমরা জাপানিদের সঙ্গে আত্মসমর্পণের জন্য আলোচনা করিনি। নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের জন্য আমরা জাপানিদের উপর দুইবার পারমাণবিক হামলা চালিয়েছি। গাজাতেও একই রকম করা উচিত,” তিনি আরও যোগ করেন। এই তুলনাটি তাৎক্ষণিকভাবে ইতিহাসবিদ, আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ এবং মানবাধিকার কর্মীদের কাছ থেকে তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। সমালোচকরা বলছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট এবং বর্তমান গাজার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং এই ধরনের তুলনা গণহত্যার উসকানি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
র্যান্ডির এমন মন্তব্যে বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার কর্মী এবং রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকগণ তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। তাদের অনেকে জানান, ফাইনের মন্তব্য ফিলিস্তিন নিয়ে মার্কিন রাজনৈতিক আলোচনায় গণহত্যার উসকানি বিপজ্জনকভাবে বেড়ে যাওয়ার প্রমাণ। ‘যুদ্ধাপরাধ’ এবং ‘গণহত্যা’র মতো গুরুতর শব্দগুলো এখন খোলাখুলিভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, যা পরিস্থিতির ভয়াবহতা নির্দেশ করে। সমালোচকরা দ্ব্যর্থহীনভাবে মত দেন যে, গাজায় পারমাণবিক হামলার পরামর্শ দিয়ে র্যান্ডি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন এবং যুদ্ধাপরাধকে সরাসরি উৎসাহিত করছেন। এই ধরনের মন্তব্য কেবল আঞ্চলিক অস্থিরতা বাড়াবে না, বরং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্যও গুরুতর হুমকি তৈরি করবে।
উল্লিখিত মন্তব্যগুলো র্যান্ডি ফাইন এমন এক সময়ে করেন, যার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেই ওয়াশিংটনের একটি ভেন্যুতে আমেরিকান ইহুদি কমিটির একটি অনুষ্ঠানের বাইরে গুলিবিদ্ধ হয়ে ইসরায়েলি দূতাবাসের দুই কর্মী নিহত হন। এই মর্মান্তিক ঘটনাটি বর্তমানে এফবিআই এবং স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলির দ্বারা নিবিড়ভাবে তদন্তাধীন। হামলাকারীর পরিচয় এবং উদ্দেশ্য এখনো স্পষ্ট নয় এবং কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রকাশ করেনি। তবে র্যান্ডি তাৎক্ষণিক মন্তব্য করে গুলি চালানোর ঘটনাটিকে ফিলিস্তিনিদের সাথে যুক্ত করে দেন এবং এটি গাজায় তার কঠোর অবস্থানের ন্যায্যতা প্রমাণে ব্যবহার করেন, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
এদিকে, গাজার মানবিক পরিস্থিতি দ্রুত এবং উদ্বেগজনকভাবে অবনতি ঘটছে। ইসরায়েলি হামলায় দৈনিক গণহত্যা থেকে শুরু করে বাড়তে থাকা দুর্ভিক্ষ ফিলিস্তিনিদের প্রতিদিনই আরও খারাপ পরিস্থিতিতে ঠেলে দিচ্ছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলি হামলায় কমপক্ষে ৫৩ হাজার ৮২২ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং এক লাখ ২২ হাজার ৩৮২ জন আহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। সরকারি গণমাধ্যম অফিস মৃতের সংখ্যা ৬১ হাজার ৭০০রও বেশি বলে জানায়, যা আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলির দেওয়া তথ্যের চেয়েও বেশি। ধ্বংসস্তূপের নিচে নিখোঁজ হাজার হাজার মানুষ মৃত বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা গাজার মানবিক সংকটকে আরও গভীর করছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং মানবিক সহায়তা প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার আহ্বান জানালেও, পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না। কংগ্রেসম্যানের এমন মন্তব্য এই ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে আরও বেশি উত্তেজনা সৃষ্টি করছে।